শহীদ ইসসাম আল আরিয়ান : সিসির অন্ধকোপে নিভে যাওয়া এক প্রদীপ


ডা. ইসসাম আল আরিয়ান। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি তার ব্যক্তিগত,রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও ট্রেড ইউনিয়নের জীবনে কখনোই ইসলামবিমুখ ছিলেন না। তিনি হেমাটলজি ও ল্যাবরেটরি মেডিসিনে দক্ষ একজন ডাক্তার ছিলেন। এমবিবিএস পাশ করার পর ক্লিনিক্যাল প্যাথোলজির উপরে কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি মাস্টার্স করেন এবং মেডিসিনে পিএইচডি করার জন্য একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বারবার গ্রেফতার আর মিশরীয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক হয়রানির কারণে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারেন নি।.

ইসসাম আল আরিয়ান শুধুমাত্র মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করেী ক্ষান্ত হননি বরং তিনি আইনের উপর কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে আরেকটি স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে তিনি ইতিহাসের উপর তার তৃতীয় স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই সাথে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক শরীয়া আইনের উপর পড়াশোনা করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক 'ল' তে ডিপ্লোমা করেন। তিনি একই সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞান ,ডিপ্লোমেসি ও আইনে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন এবং একজন মুজতাহিদ ছিলেন।

তিনি ১৯৭৪ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদানের পর গিজা প্রদেশে ব্রাদারহুডের পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন । তিনি "কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট ইউনিয়নে"র প্রতিনিধি, "জেনারেল ইউনিয়ন অফ ইজিপশিয়ান ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট" এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২-৭৭ সময়কালের জন্য "কায়রো মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন" এর কালচ্যারাল কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮১ সালে তাকেসহ আরো বেশ কয়েকজন ইসলামিস্টকে আটক করা হয় এবং সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। অবশ্য একবছর পরেই তিনি ছাড়া পান।

তিনি ১৯৮৬ সালে "মিশরীয় মেডিক্যাল সিন্ডিকেট"এর বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেলের পদ লাভ করেন। ফিলিস্তিনের জনগণকে সহায়তা করতে তিনি "Professional gatherings forum for the cause of Palestine" নামে একটি জনপ্রিয় সংগঠন গড়ে তুলেন।

১৯৮৭-১৯৯০ লেজিসলেটিভ টার্মে তিনি ইম্বাবা জেলা থেকে মিশরীয় গণপরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন,যদিও সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই পরিষদটি বাতিল করা হয়।

১৯৯৫ সালে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের কিছু সদস্যদের সাথে আবারো গ্রেফতার হন। ২০০৫ সালের মিশরীয় নির্বাচনে তিনি ব্রাদারহুডের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারেন এই আশংখায় আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৬ সালে বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণের দায়ে, ২০০৭ সালে ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব দানের অপরাধে ও ২০১১ সালে মোবারকবিরোধী আন্দোলন চলাকালে কারাভোগ করেন তিনি।

জানুয়ারি বিপ্লবের পর তিনি আবার গণপরিষদে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন এবং গণপরিষদের "ফরেন এফেয়ার্স কমিটির" সভাপতি ছিলেন।

তিনি আরব ন্যাশনাল ইসলামিক কনফারেন্স ও Egyptian Organization for Human Rights এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন । একই সাথে Arab Organization for Human Rights এর সহযোগী সদস্য ছিলেন । তিনি ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বে অনেকগুলি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সেমিনার এবং সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।

ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তিনি সবসময়ই উচ্চ কন্ঠ ছিলেন। মিসরীয় ইহুদিদেরকে মিশর থেকে বহিস্কার করার জন্য তিনি জামাল নাসেরের কঠোর সমালোচনা করতেন এবং এক টিভি সাক্ষাৎকারে মিশরীয় ইহুদিদেরকে মিশরে ফিরে আসার আহ্বান জানান যাতে প্রকৃত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাসস্থান ফিরে পায়। তিনি মনে করতেন ইসরাইলী ইহুদি সে হোক ইউরোপীয়,মিশরীয় বা পোলান্ডের সকলেরই উচিত ফিরে যাওয়া ।

ইসসাম আল আরিয়ান তার জীবদ্দশায় ক্লান্তিহীনভাবে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্রাদারহুডের মিত্র বানানোর জন্য কাজ করে গেছেন। ২০১৩ সালে মুরসির বিজয়ের পেছনে অন্যতম রাজনৈতিক কারণ ছিলো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলকে মুরসির পক্ষে নিয়ে আসা। লেবার পার্টি, গাদ পার্টি, ওয়াফদ পার্টি, তাগাম্মু পার্টির সাথে বিরতীহীনভাবে যোগাযোগ ও তাদেরকে প্রভাবিত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শ ও রাষ্ট্রনীতি তুলে ধরে নিয়মিত লেখালেখি করতেন তিনি।

তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের গাইডেন্স ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠার আগে এর রাজনৈতিক কার্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সর্বশেষ দলটির সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০১৩ সালের জুলাইয়ে মুরসির পতনের পরে ৩০ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করে সামরিক সরকার এবং তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। তিনি হেপাটাইটিস সহ আরো নানবিধ রোগে ভোগছিলেন । ২০১৯ সালের প্রথম দিকে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে তার সাথে পরিবারের দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয়া হয়।

প্রায় সাত বছর মিশরের কুখ্যাত স্করপিয়ন কারাগারে অমানবিক অবস্থায় দিনাতিপাত করার পর ১৩ আগস্ট তিনি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৬৬ বছর বয়সে শাহাদাৎ বরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় ছয়মাস আগে তিনি তার পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাৎ করেছিলেন ।২৮ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে ইম্বাবা এলাকার নাহইয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।


তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া

Post a Comment

0 Comments