হামাসের প্রাণপুরুষ শেখ আহমাদ ইয়াসিন (রাহিঃ)

 


হামাসের যাত্রা শুরু ১৯৮৭ সালে। লেবাননের ‘শিয়া’ সংগঠন হিজবুল্লাহর আদলে গাজায় গড়ে ওঠে মূলত সুন্নী সংগঠন হামাস।
সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে গাজাবাসীর রোজকার সমস্যা (পয়ঃনিষ্কাশন, পানি, বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, খেলার সরঞ্জামাদি) সমাধানে মন দেয় সংগঠনটি। প্রয়োজনে হাতের কাছে সব সময় পাওয়া যায়, ভরসা করা যায়, এমনই বস্তুতে পরিণত হয় হামাস। হামাস মানেই সমস্যার সমাধান। চাঁদাবাজি নেই, প্রোটেকশন মানির দাবি নেই। এমন একটা প্রতিষ্ঠান অবরুদ্ধ শহর গাজায় গড়ে তোলেন লোকপ্রিয় নেতা শেখ আহমদ ইসমাইল ইয়াসিন। প্রায় অন্ধ, বারো বছর বয়স থেকে হাঁটতে না পারা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারা, এমন একটা অপ্রয়োজনীয় মানুষ নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন ফিলিস্তিনিদের জন্য। গাজার বাইরেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়।

ইসরাইল অধিকৃত আশকালন শহরের কাছেই এক ছোট গ্রাম আল জুরায় ১৯৩৭ সালের পয়লা জানুয়ারি তার জন্ম। তবে আমাদের দেশে পয়লা জানুয়ারিতে জন্ম নেয়া প্রায় সব মানুষের জন্ম নিয়ে যেমন দু’খান কথা থাকে, শেখ ইয়াসিনের জন্ম তারিখ নিয়েও তেমন দ্বিমত আছে। আসলে তিনি ১৯৩৮ সালে জন্মেছিলেন। সে যা-ই হোক, তিন বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে শেষে মায়ের পরিচয়েই বড় হয়েছেন। আহমদ ইয়াসিন বাবার নামে পরিচিত না হয়ে তিনি পরিচিত হন আহমদ সা’দা হিসেবে- তার মায়ের নাম ছিল সা’দা আল হাবেল। ১৯৪৮ সালে তাদের গ্রাম ইসরাইলের দখলে চলে গেলে দশ বছরের বালক আহমেদের জায়গা হয় গাজার আল সাথি শরণার্থী শিবিরে। চার ভাই আর দুই বোন নিয়ে শুরু হয় তাদের শিবির জীবন। বেড়ে ওঠার প্রতিটা সময় তিনি লক্ষ করেছেন শরণার্থী শিবিরের কষ্টের দিকগুলো। শিবির জীবনের দু’বছরের মাথায় যখন তারবয়স মাত্র বারো, বন্ধুর সঙ্গে কুস্তি খেলতে গিয়ে মেরুদন্ডে প্রচন্ড আঘাতপান। টানা পঁয়তাল্লিশ দিন তার গর্দান প্ল্যাস্টার করে রেখেও শেষরক্ষা হয় না। আহমেদ সারা জীবনেরজন্য পঙ্গু হয়ে যান। চোট পেলেও দুই পরিবারের মধ্যে যাতে প্রতিশোধের আগুন না জ্বলে। বলেছিলেন ব্যাঙ ব্যাঙ খেলতে গিয়ে নিজে নিজেই চোট পেয়েছেন।

কায়রোর বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর অসুস্থতার কারণে তাকে শরণার্থী শিবিরে ফিরে আসতে হয়। অনেকটা আমাদের আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্রের মতো। সেই ফেরা তার শাপে বর হয়। বাড়িতে বসে পড়ে ফেলেন দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর ধর্মের নানা বিষয়। প্রকৃত পন্ডিত হয়ে ওঠেন।

মসজিদে জুমার নামাজ পড়ানোর জন্য ডাক আসে তার। তার খুৎবার বয়ান ছিল খুবই জ্ঞানগর্ভ আর দৈনন্দিনের সমস্যাকে সহজে তুলে ধরার এক নৈপুণ্যে ভরা শিল্প। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত সেসব। মানুষ খুঁজে নিত কোন মসজিদে আহমদের বয়ান হবে। তরুণদের আকৃষ্ট করত তার আধুনিক রূপক, আর তথ্য ব্যবহারের ক্ষমতা। বক্তৃতা, খুৎবায় মানুষের ঢল নামলে পেট চলে না, পেট চালানোর জন্য চাই একটা চাকরি বা ব্যবসা, কোনোটাই তার কাছে ধরা দেয় না। শেষ পর্যন্ত চাকরি মেলে এক প্রাথমিক স্কুলে আরবি শেখানোর চাকরি। স্কুলের হেড মাস্টার মোটেও রাজি ছিলেন না। সাধারণ শিক্ষকদের পক্ষেই ক্লাসে শান্তি বজায় রাখা যখন কঠিন সেখানে হুইল চেয়ারে বসা এক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কীভাবে সামাল দেবে? পরে বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি লক্ষ্য করেন, তার আশঙ্কা কতটা ভুল ছিল। ছাত্রদের কাছে তিনি হয়ে যান হ্যামিলনের বংশীবাদক, সবচেয়ে চঞ্চল ছাত্রটিকেও বশীভূত করে ফেলেন শিক্ষক আহমদ। শুধু ক্লাসে নয়, ছাত্ররা তার পিছু পিছু মসজিদেও যেতে থাকে। অনেক অভিভাবকের আপত্তি ছিল ক্লাসের বাইরে তাকে অনুসরণের ক্ষেত্রে। কিন্তু তিনি ক্রমশই সবাইকেই তার অনুরাগী করে তোলেন।

অনেকের মতে, অন্যের কষ্ট অনুধাবনের এক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার। আসলে তিন বছর বয়সে পিতা হারিয়ে দশ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে বারোতে এসে সারা জীবনের জন্য পংগু হয়ে এ দুয়ারে ও দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এতোটাই জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন যে, তাকে এক কথা দু’বার বলতে হতো না। অনেক সময় বলতেই হতো না তিনি বুঝে নিতেন মুখ দেখে। তারপর ছিল তার অপরিসীম জ্ঞান আর আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। এই জ্ঞানটাই তিনি ব্যবহার করেছেন হামাসকে সংগঠিত করার সময়।

মানুষের কোন প্রয়োজনটি আগে? শরণার্থী শিবিরের শিশুরা যেন মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে, সেটা তিনি দেখান তার মূল লক্ষ্য হিসেবে। স্কুল, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, আর সেগুলোকে সবার সমান নাগালে রাখা হয়ে ওঠে হামাসের মূল কাজ। মানুষ কাছে টেনে নেয় হামাসকে। ততদিনে ইয়াসির আরাফাতের আল-ফাত্তাহ আর সব সংগঠনকে নিয়ে গড়ে তোলা পিএলও মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। নেতারা এক একজন মুঘল বাদশাহ বনে গিয়েছেন, কেউ আমাদের শাহজাহান কেউ জাহাঙ্গীর। অসলো চুক্তির পর পিএলও পশ্চিম তীরে ফিরে আসার সুযোগ পায়, সঙ্গে আসতে থাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সৌদি, কুয়েতি, কাতারি ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, সুইডেন থেকে টাকা আসে পুনর্গঠনের জন্য। সেসব টাকা শেষ পর্যন্ত মানুষের কাজে লাগেনি; দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া পিএলও আর তার অঙ্গ-সংগঠনগুলোর হোমরাচোমরারা সে দেশের হলমার্ক আর রাবিশ এবং বোগাস মার্কা মন্ত্রীরা লুটপাট করে নেয়। আরাফাত বসে বসে দেখেন সেসব কারবার। অন্যদিকে শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের সংগঠন ব্যক্তিগত ইয়ানতি চাঁদার ওপর নির্ভর করে একটার পর একটা সফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে থাকে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা এবার তাদের খুচরা দান পাঠাতে থাকে হামাসের ঠিকানায়। হামাস প্রতিটা পাই পয়সার হিসাব রাখে সর্বাধিক স্বচ্ছতা আর দক্ষতার সঙ্গে। শক্ত সামাজিক সংগঠন হওয়ায় আর ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতি রেখে কাজ করায় নৈতিকতার একটা নতুন মান তারা রচনা করে। এটা হামাসকে ‘ফিলিস্তিনি বেঈমান’দের পাকড়াও করার তাকত দেয়।

ইসরাইলের গোয়েন্দাদের টাকা খেয়ে অনেক ফিলিস্তিনি ‘নেশাখোর বেঈমান’ ইসরাইলের কাছে গোপন সব খবর পাচার করতে থাকে। কোন নেতা কোথায় থাকেন, কখন আসেন, ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে সেসব খবর কিনে নিয়ে চোরাগোপ্তা হত্যা ইসরাইলের অনেক দিনের পেশা। হামাসের এসব ঘরের শত্রু নিধন কার্যক্রম তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়। গাজা আর পশ্চিম জেরুসালেমের নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে ফাত্তাহকে পর্যুদস্ত করে হামাস জনপ্রতিনিধিত্বের মুকুট পেয়ে যায়। এটাও হামাসের একটা বড় শক্তি।

ইসরাইলের অবরোধ কাটিয়ে গাজার লোকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব গোপন সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল, তার সবগুলোতেই ছিল হামাসের বুদ্ধি, জ্ঞান আর অর্থ। অবরুদ্ধ আর যুদ্ধবিধ্বস্ত এক টুকরা বসতিকে সস্তায় বিনোদনের সুযোগ তৈরির জন্য হামাসের তৈরি পার্ক, বাগান, খেলার মাঠ, ফুটবল ময়দান, চিড়িয়াখানা, রেস্তোরাঁ বিনোদনের পাশাপাশি অনেক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। গাজার উপকূলে পাওয়া গ্যাস হামাসের ব্যবস্থাপনায় চলে গেলে ইসরাইলের তা থেকে ফায়দা নেয়ার খায়েস কখনো পূর্ণ হবে না। ইসরাইল চায় গ্যাস তারা নেবে, দাম শোধ করবে টাকায় নয় সামগ্রী দিয়ে, মানে বাটার সিস্টেমে। হামাস এটাতে রাজি নয়। তারা যত আন্তর্জাতিক দামে নগদে কিনবে তার কাছে বেচতে চায়।

গাজায় হামাসরা থাকলে ‘ন্যায়নীতির প্রশাসন চালু রাখলে’ মিসরের কাবু অর্থনীতি সামরিক চাবুক বেশিদিন সইবে না। তারাও হামাসি গণতন্ত্র চাইবে। অতএব মিসরের শিশি বোতল কেউই চায় না হামাসের বাড় বাড়ন্ত অবস্থা। সৌদিরা কোনো অবস্থাতেই কোন আরব দেশে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন দেখতে চায় না। অতএব তারাও হামাসকে পছন্দ করে না। হামাসকে ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিন, সিরিয়ায়, লিবিয়ায় সঙ্ঘাতে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশত্যাগী নেতারা হিজরত করে এখন কাতারে থাকেন। সবাই ভাবছেন, হামাসকে খতম করে আবার ফাত্তাহ ইত্যাদির মাধ্যমে গাজাকে গড়ে তুলবে। ইসরাইলের বশংবদদের নেতৃত্ব থাকবে সেখানে। তবে মাটি থেকে উঠে আসা কোনো গণসংগঠনকে হাতুড়ি শাবল দিয়ে উৎপাটন করা যায় না। আকাশের বোম তো অনেক দূরের কথা। আকাশ থেকে গোলা ছুড়ে ফজরের নামাজ পড়া অবস্থায় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইয়াসিনকে তার হুইল চেয়ারে হত্যা করে ইসরাইল আরও মজবুত করেছে হামাসের প্রতি সাধারণ মানুষের হামদর্দীকে। দু’লাখ লোকের ঢল নেমেছিল তার জানাযায়। গাজার কোনো পরিবার ছিল না যাদের কেউ না কেউ ছিল সে মিছিলে খ্রিষ্টান-মুসলমান নির্বিশেষে। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন ইসলামী আন্দোলনের এই মজলুম সিপাহসালারকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।

Post a Comment

0 Comments