তিনিই ছিলেন আল্প আরসালান। আল্লাহতে বিশ্বাসী এক মুসলিম সাহসী যুবক। কোন এক যুদ্ধ শেষে তার বাকী সৈন্যদের নিয়ে রাজধানী খোরাসানে ফিরছিলেন। এই খবরটি শুনতে পেল কনস্টান্টিনোপল সম্রাট রোমানুস, সে ৬ লাখ সৈন্যের একটি বিশাল বহর প্রস্তুত প্রস্তত করে এগিয়ে আসছে। ওয়াল্লাহি! তার এই বিশাল বহরটি ছিল ভয়, দূর্বলতা ও হীনমন্যতায় ভরপুর।
এই খবর পৌছলো আরসালানের নিকট, তখন তার নিকট ছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর পথে জিহাদরত ১৫ হাজার মুজাহিদ।
লক্ষ করুন, উভয় বাহিনীর মাঝে তুলনা করুন। ৬ লাখের মোকাবেলা করবে ১৫ হাজার সৈনিক। অর্থাৎ একজনকে লড়তে হবে চারশো জনের বিরুদ্ধে।
এসব কি শারীরিক শক্তি দ্বারা সম্ভব? না, নিশ্চয় এতে আছে ঈমানী শক্তি। আর প্রিয় ভাইয়েরা! এটাই যথেষ্ট।
তিনি তার সৈনিকদের দিকে তাকালেন। তারা যুদ্ধে বিধ্বস্ত, আবার অনেকেই তাদের মাঝে গুরুতর আহত, দীর্ঘ সফর তাদেরকে ক্লান্ত করে তুলেছে। তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন, হিসেব মিলাতে লাগলেন। সৈনিকদের দিকে আবার তাকালেন। তিনি কি কুফফারদের এতবড় বাহিনীকে ছেড়ে দিবেন? তখন তারা তার দেশে প্রবেশ করে ধ্বংসলীলা চালাবে নাকি তিনি এই ১৫ হাজার সৈন্যকে ৬ লাখের মোকাবেলায় নামানোর ঝুঁকি নিবেন। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন।
অতঃপর ঈমানী চেতনা তাকে নাড়া দিল, আক্বীদা ঠিকরে পড়লো, তিনি স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তারপর তাবুতে প্রবেশ করে পরিধানের কাপড় ছেড়ে শরীরে হানুত লাগালেন। (হানুত: মৃত ব্যক্তির শরীরে যে সুগন্ধি লাগানো হয়)। এরপর কাফনের কাপড় পড়ে বের হয়ে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন:
"আজ ইসলাম ও মুসলিমগণ বিপদের সম্মুখীন। আমার ভয় হচ্ছে, না জানি কালিমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়ে।"
তারপর তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন: "হায় আমার ইসলাম! হায় আমার ইসলাম! দেখ আমি শরীরে হানুত লাগিয়ে কাফন পরে নেমেছি। যে ব্যক্তি জান্নাত চায় সে যেন আমি যা পরেছি তা পরে নেয়। আমরা কালিমার পথে লড়ে যাব। হয়তো মৃত্যুবরণ করবো নয়তোবা আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হবে। হয়তো ওহীর বাণী কিংবা ধারালো তরবারী যার তীক্ষ্ণ ফলা গেঁথে যায় উদ্ধতদের ধমনিতে প্রথমটি ক্ষত সারাবে বোধসম্পন্ন ব্যক্তির আর দ্বিতীয়টি আরোগ্য দিবে অজ্ঞ ও নির্বোধকে।"
কিছু সময়ও অতিবাহিত হলোনা, পুরো মুসলিম বাহিনী কাফনের কাপড় পরে নিলেন। চারিদিকে হানুতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। জান্নাতের বাতাস বইতে লাগলো। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আল্লাহু আকবার। ওহে আল্লাহর অশ্বারোহীগণ! দৃঢ় হও। ওহে আল্লাহর অশ্বারোহীগণ! সওয়ার হও।
লা ইলাহা ইল্লালাহ। তোমরা কি কখনো কাফনাবৃত বাহিনীর কথা শুনেছ? শুনেছ কি কখনো তাদের কাহিনী যারা যুদ্ধে প্রবেশের আগে হাশরের পোষাক পরে নিয়েছিল? তোমরা কি কখনো একসাথে পনের হাজার মুসলিমের হানুতের ঘ্রাণ নিয়েছ?
তোমরা কি কল্পনা করতে পারছো যুদ্ধে রওয়ানা হওয়া পুরো একটি বাহিনীর চিত্র যারা বিশ্বাস করতো জমিনের প্রত্যেককেই হাশরের দিন পুনরুত্থিত করা হবে।
উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো, উভয় দলের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হলো। একদল যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তার সাক্ষাতে অধির হয়ে আছে। অপরদল যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে, তার সাক্ষাতকে অপছন্দ করে। গর্জনে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো, আল্লাহু আকবার। মুমিনগণ প্রত্যেকেই ঝাপিয়ে পড়লো আর তাদের মুখ ফুটে যেন বের হচ্ছিলো:
আমার প্রভু! আমি দ্রুত আপনার কাছে এলাম যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন।
- সুরা ত্বোহা: ৮৪।
খুলি উড়ে যেতে লাগলো, মস্তকগুলো ধড় থেকে নেমে গেল। রক্ত বইতে লাগলো। প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে আওয়াজ ভেসে এলো, রোমানরা পরাজিত হয়েছে। তাদের সেনাপতি রোমানুস বন্দী হয়েছে।
আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। তিনি তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, তার সৈনিকদের বিজয়ী করেছেন।
কত ছোট ছোট দল রয়েছে যারা বড় দলের উপর বিজয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে।
- সুরা বাকারা: ২৫০।
আল্লাহর সৈনিকদের অনেকেই শহীদ হলেন, বাকীরা কাঁদতে লাগলেন। তারা কি গনীমত হাতছাড়া হওয়ার দুঃখে কাঁদছেন?
না। যিনি খুঁটিহীন আসমান স্থাপন করেছেন তার শপথ।
তারা তো কাঁদছিলো নিজেদের জীবনকে আল্লাহর নিকট বিক্রয় করার পরও পরনের কাফন খুলে ফেলতে হবে বিধায়।
অপরদিকে মুসলিম সেনাপতি দীর্ঘক্ষণ কাঁদলেন, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
তিনি জিহাদে অটুট থেকেছিলেন। একসময় আল্লাহর সাথে সেই বিশ্বাস নিয়ে সাক্ষাত করলেন, যে বিশ্বাসের সামনে দাড়াতে পারেনি কোন শক্তি। যেদিন তার মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়েছিল তিনি বলেছিলেন: আহ! কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু প্রয়োজন পূরণ হয়নি। আফসোস থেকেই গেল।
তিনি তরবারীর ছাঁয়ায় মরতে চাই়তেন। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন তাকে বিছানায় মৃত্যু দিতে।
মুমিনের অন্তরের সামান্য ঈমানও অধিক শক্তিশালী, যেন হাজার তরবারী
মূল: শায়খ আব্দুল খালিক আল ক্বারনী
0 Comments