খেলাফতের পতনের সময়ে ইমাম হাসান আল বান্নার (রহ:) উপদেশ।



খেলাফত পতনের সময়টিতে হতাশা ও যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়েন উম্মাহর বহু দাঈ ও মুসলিহগণ। কিন্তু হতাশার এই প্রাচীর চিরে দীপ্তকন্ঠে ভেসে এসেছিল একটি বাণী। উদ্দীপনায় ভরা কণ্ঠ সেদিন বলেছিল, ‘হে আমার জাতি! নতুনকরে ইসলামে আবার ফিরে আসুন। এখানেই রয়েছে আপনাদের সম্মান ও মর্যাদা। এখানেই রয়েছে শান্তি ও সুখ।’


ইমাম হাসান আল বান্না রহ.। দুর্যোগকালে খেলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা। প্রিয় ইমামের একটি বক্তব্য অনুবাদ করে দেয়া হলো। ইমাম বান্না ইসলামি আন্দোলনের যুবকের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলেছেন, দাওয়াতের গুরুত্ব স্পষ্ট করেছেন। হারিয়ে যেতে চান সেই সেই দায়ীর হাত ধরে?


তার বক্তব্যের সারাংশ: 

হে যুবক! একটি চিন্তা তখনই সফলতার মুখ দেখে যখন এর প্রতি বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়, এর পথে একনিষ্ঠতা পূর্ণতা পায়, আবেগ উদ্বেলিত হয়। যখন কোরবানী ও পরিশ্রমের জন্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। আর বিশ্বাস, একনিষ্ঠতা, উদ্যম ও পরিশ্রম এই চারটি ভিত্তির সবকটির দেখা মিলে একমাত্র যুবকদের মধ্যেই। কেননা বিশ্বাসের ভিত্তি হলো বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর। একনিষ্ঠতার ভিত্তি হলো, স্বচ্ছ হৃদয়। আবেগের ভিত্তি হলো দৃঢ় উপলব্ধি আর পরিশ্রমের ভিত্তি হলো অজেয় সংকল্প। এই বিষয়গুলো একমাত্র যুবকদের মাঝেই থাকা সম্ভব। এই কারণে যুগে যুগে যুবকেরাই ছিল প্রতিটি জাতির উত্থানের মূলভিত্তি আর শক্তির চাবিকাঠি। তারাই ছিল চিন্তার সঠিক ধ্বজাধারী।


 إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى

তারা ছিল কয়েকজন যুবক, যারা তাদের রবের উপর ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের হিদায়াত আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম।


হতাশ হবেনা। হতাশা মুসলিমের চরিত্র নয়। গতকালের স্বপ্ন, আজকের বাস্তবতা। আর আজকের স্বপ্ন, আগামীকালের বাস্তবতা। সময় এখনো পর্যাপ্ত। বিশৃঙ্খলা চারিদিক ছড়িয়ে পড়লেও শান্তি ও নিরাপত্তা আজও তোমাদের মুমিন হৃদয়ে প্রবলভাবে বিদ্যমান। দূর্বল সারাজীবন দূর্বল থাকেনা একইভাবে শক্তিশালীর শক্তি চিরস্থায়ী থাকেনা।


وَنُرِیۡدُ اَنۡ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَنَجۡعَلَہُمۡ اَئِمَّۃً وَّنَجۡعَلَہُمُ الۡوٰرِثِیۡنَ ۙ

যমীনে যাদের দূর্বল করা হয়েছিল, আমি ইচ্ছে করলাম তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা বানাতে এবং পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করতে।


নিশ্চয় সময় একদিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বের করে আনবে, বহু মহান কাজের সুযোগ তৈরী করবে। পৃথিবী আজ তোমাদের দাওয়াতের অপেক্ষায় ব্যাকুল হয়ে আছে। হেদায়েত, সাফল্য ও শান্তির সে দাওয়াত। তুমি এসে পৃথিবীকে আজকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিবে বলে। বিশ্বের পরিচালনা ও বিভিন্ন জাতির নেতৃত্বের দায়িত্ব আজ তোমার কাঁধেই এসে বর্তায়।


وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ

আর সে দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি।


وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ

আর তোমরা আল্লাহর কাছে তা আশা কর, যা তারা করেনা।


অতএব হে যুবক! আজ থেকেই কাজে নেমে পড়, হতে পারে আগামীকাল তোমরা কাজ করতে অক্ষম হবে।


আর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য ২০টি মুক্তামালা পেশ করছি।


১. তোমরা যে অবস্থায় থাক না কেন আজান শোনার সাথে সাথে নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।


২. কুরআন পাঠ কর এবং এটা নিয়ে গবেষণা কর-যত কম সময়ই হোক না কেন। আজেবাজে কাজে সময় ব্যয় কর না।


৩. সবসময় স্পষ্টবাদী হওয়ার চেষ্টা কর কেননা এর দ্বারাই প্রমাণ হবে তুমি মুসলিম। আরবি শিখার চেষ্টা কর কেননা কেবলমাত্র আরবি ভাষার মাধ্যমেই কুরআনকে ভালোভাবে বুঝা সম্ভব।


৪. কোনো বিষয়েই মাত্রারিক্ত তর্কে জড়াবে না- কেননা এটা কোনো সময় সফলতা বয়ে আনে না।


৫. কখনোই বেশি হাসবে না কেননা- আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত আত্মা সবসময় শান্তচিত্ত ও ভারি হয়।


৬. কখনোই মশকরা করো না- কেননা একটি মুজাহিদ জাতি চিন্তাশীল ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।


৭. শ্রোতা যতটুকু পছন্দ করে ততটুকুই তোমার আওয়াজ উচ্চ কর-কেননা তা না করা স্বার্থপরতা ও অন্যকে নিপীড়ন করার শামিল।


৮. কখনোই কাউকে ছোট কর না-কল্যাণকর ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলো না।


৯. তোমার প্রতিবেশী কোনো ভাই তোমার সাথে পরিচিত হতে না চাইলেও তার সাথে পরিচিত হও।


১০. আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আমাদের যে সময় দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি-অন্য জনের সময় বাঁচানোর জন্য সবসময় ব্রত হও। যদি তোমার উপর কোনো দায়িত্ব অর্পিত হয় সেটাকে সবচেয়ে সহজ পন্থায় ও সুন্দর করে করার চেষ্টা কর।


১১. সবসময় পরিষ্কার-পরিছন্নতার দিকে নজর দেবে-তোমাদের ঘরবাড়ি; পোশাক পরিচ্ছদ; শরীর ও তোমাদের কাজের জায়গাকে পরিচ্ছন্ন রাখ। কেননা এই দ্বীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপরেই নির্মিত হয়েছে।


১২. তোমাদের ওয়াদা; তোমাদের কথা ও কাজে সবসময় মিল রাখবে-শর্ত যাই হোক না কেন সর্বদাই এর উপর অটল অবিচল থাকবে।


১৩. পড়ালেখায় মনোযোগ দাও-মুসলিমদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন নিয়ে পরস্পর আলোচনা কর। ছোট হলেও নিজস্ব একটা লাইব্রেরি গড়ে তোল। নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে গভীরজ্ঞানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা কর।


১৪. কখনো সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী হবে না। কেননা রিজিক এর সবচেয়ে সংকীর্ণ দরজা হলো এটা। তবে তোমরা যদি সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা পাও তা প্রত্যাখ্যান কর না। এই চাকরি তোমাদের দাওয়াত ও নিজস্ব গতিকে স্তব্ধ করে না দেয়া পর্যন্ত এর থেকে পৃথক হবে না।


১৫. তোমাদের সম্পদের একটা অংশ ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে দান কর। জাকাত দাও, তার পরিমাণ যত স্বল্পই হোক না কেন সেখান থেকে গরিব-দুঃখীদের দান কর।


১৬. অপ্রত্যাশিত বিপদ আসার আগেই স্বল্প পরিমাণ হলেও সম্পদের একটা অংশকে সঞ্চয় কর। কখনোই জাঁকজমক পূর্ণ আসবাব পত্র ক্রয়ে সম্পদ ব্যয় কর না।


১৭. সকল অবস্থায় তাওবা ও ইস্তিগফার পাঠ কর। রাতে ঘুমানোর আগে কয়েক মিনিট আত্মসমালোচনা কর। হারাম থেকে বেঁচে থাকার জন্য সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাক।


১৮. বিনোদন এর জায়গা থেকে এই ভেবে দূরে থাক যে, এর বিরুদ্ধেই আমার সংগ্রাম। সকল প্রকার প্রসন্নতা ও আরামদায়ক বিষয় থেকে দূরে থাক।


১৯. সকল জায়গায় তোমার দাওয়াতকে বুলন্দ করার চেষ্টা করবে। নিজের নফসের সাথে এমন আচরণ করো, যাতে সে তোমাকে মেনে চলতে বাধ্য হয়। তোমাদের চোখকে হারাম থেকে বিরত রাখ। নিজের আবেগের উপর প্রাধান্য বিস্তার কর।


২০. নিজেকে সর্বদাই সংগঠন এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত রাখ। একজন নিবেদিত প্রাণ সেনার মতো নেতার আদেশ মানতে সর্বদাই প্রস্তুত থাক।  








সূত্র: আরশাদ আনসারী, দৈনিক সংগ্রাম, উইকিপিডিয়া


Post a Comment

0 Comments