ইখওয়ানুল মুসলিমিন - মুসলিম ব্রাদারহুড

যেভাবে ইখওয়ানের সূচনা হলো:

নীল নদের দেশ মিসর, মুসা নবীর (আ:) দেশ মিশর, ফেরাউনের দেশ মিসর, পিরামিডের দেশ মিসর,
জামাল নাসেরের দেশ মিসর। এই নীল নদের দেশ মিসরে চলছিল ফেরাউনী সভ্যতা পুনরুজ্জীবনের
জঘন্য অপপ্রয়াস। ইসলামের চিহ্ন মুছে ফেলার সকল আয়োজন চলছিল সর্বত্র। এমন এক সংকটময় মুহুর্তে আন্দোলনের পতাকা হাতে ছুটে আসেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তান ইমাম হাসানুল বান্না।


১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ইসমাঈলিয়ার একদল সম্ভ্রান্ত ও সচেতন ব্যক্তি হাসানুল বান্নার বাসায় সমবেত হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে হাসানুল বান্না তাঁদের সামনে তাঁর চিন্তাধারা পেশ করেন এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার উপাখ্যান তুলে ধরেন। এ আলোচনা সভায় আগত ছয় জন সদস্যরা হলেন:
১. হাফিয আবদুল হামীদ
২. আহমাদ আল হাসরী
৩. ফুয়াদ ইবরাহীম
৪. আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ
৫. ইসমাইল ইজ্জ
৬. যাকী আল মাগরিবী।



আলাপ আলোচনা ও পারস্পরিক মতবিনিময়ের পর তারা হাসানুল বান্নাকে কাজের তত্ত্বাবধায়ক নেতৃত্ব এবং পথ- নির্দেশনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাছাড়া উক্ত আলোচনা সভায় মুসলমানদের রক্ষার জন্য সকল ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রয়াসে বায়আত গ্রহণ করেন। এই সংগঠনটির নাম কি হবে এ নিয়ে কথা উঠতেই হাসানুল বান্না তৎক্ষণাত বললেন - আমরা সবাই ইখওয়ানূল মুসলেমুন-(মুসলমান ভাই) আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এমনিতেই এ নামটি মুখ থেকে শায়খের বেরিয়ে পড়ে। আর এ থেকেই এ সংগঠনটি ইখওয়ানুল মুসলেমুন নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এই সংগঠনের আলমুরশিদুল আম নির্বাচিত করা হয় হাসানুল বান্নাকে। এইভাবে ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ইসমাঈলিয়াতে ইখওয়ানূল মুসলিমূন গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে তখন হাসানুল বান্নার বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর।

১৯৩৩ সনে হাসানুল বান্নার আহ্বানে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় আল ইখওয়ানের প্রথম সাধারণ সম্মেলন।মিসরে তখন খৃস্টান মিশনারীদের ব্যাপক তৎপরতা চলছিলো। এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিং ফুয়াদকে একটি চিঠির মাধ্যমে খৃস্টান মিশনারীর তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করা হয়। হাসানুল বান্না যখন কালের গতিধারাকে পরিবর্তন করে দাঁড়িয়েছিলেন প্রবল তুফানের সম্মুখে তখনই ইসলাম বিদ্বেষী আবুজেহেল আবু লাহাবের উত্তরসূরীরা একজোট হয়ে তাঁর দাওয়াতী মিশনকে বাধাগ্রস্ত করার এজেন্ডা গ্রহণ করেছিল। যারা মনে করতো যে, ইসলাম ও মুসলমান মৃত ঘোড়ার মতো। তাঁরা হাসানুল বান্নার সংস্কার ও পুনর্জাগরণের সংকল্প সম্পর্কে উপহাস করা শুরু করল। তবু হাসানুল বান্না মনোবল হারাননি। কারণ হাসানুল বান্না বিদ্বানের চেয়ে অনেক বড় দায়ী ইলাল্লাই ছিলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচক্ষণতার পাশাপাশি তার মাঝে একজন দায়ী ইল্লাল্লাহ্র পরিপূর্ণ চরিত্র বিদ্যমান ছিল। মিসরের তৎকালীন স্বৈরশাসক তাঁর দাওয়াতী কাজের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক এঁকেছিল। তারপরেও থেমে থাকেনি ইখওয়ানের দাওয়াতী তৎপরতা।




মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের নিকট ইখওয়ানের দাওয়াত:
ইখওয়ান কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এ পর্যন্ত এসেছে তা জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পেছনের দিকে। কারণ অতীত ইতিহাস জানা না থাকলে ইখওয়ানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দ্বীনি দাওয়াত সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট ফারুক, প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা এবং আরব বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কাছে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা আকারে পত্র দেয়া হয়। পত্রের শিরোনাম ছিল ‘‘আলোর ডাক”। এ পত্রের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক ধারণাগুলো তুলে ধরা হয়।


এছাড়াও অত্র পত্রে উল্লেখ করা হয় যে, পাশ্চাত্য জীবনধারা এবং সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা মোটেও সুখকর নয়। ওই চিঠির সমাপ্তিতে লেখা হয় একথা বলে, আমরা আমাদের সকল শ্রম, যোগ্যতা ও উপকরণ সবকিছু সেই সরকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত আছি- যারা উম্মতে মুসলিমার উন্নতি ও কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রাণ উৎসর্গ করতে বদ্ধপরিকর হবে। আমরা তাদের প্রতিটি ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবো এবং সকল ত্যাগ ও কোরবানী করতে প্রস্তুত থাকবো। এই সুন্দর ঘোষণা দেয়ার পরও ইখওয়ানের দাওয়াতী কাজের বিরোধিতা তো কমেনি বরং বাড়িয়ে দিয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি।


ইখওয়ানের সাংগঠনিক বিস্তৃতি :
ইখওয়ানের অন্যতম নেতা শায়খ হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া শহর চষে বেড়াছেন। তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ইসলামের আলো ছড়াতেন। তাঁর দাওয়াতে বেশ কিছু লোক সাড়া দেন। ইমামের মতো ইখওয়ানের নেতাকর্মীরা দাওয়াতী কাজ বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে করতেন। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে তাঁরা যেতেন, তাদের সাথে মিশতেন, তাদের কথা শুনতেন ও তাদেরকে দ্বীনের কথা শুনাতেন। মাত্র চার বছরের মধ্যেই ইখওয়ান একটি জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়।

ইসমাঈলিয়াতে ইখওয়ানের অনেকগুলো শাখা গড়ে তোলা হয়। ইসমাঈলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়
ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আর সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ। কিছুদিন পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বালকদের জন্য একটি ও বালিকাদের জন্য আলাদা স্কুল নির্মাণ করা হয়। এই স্কুল দু’টির শিক্ষাপদ্ধতি দুই ধরনের ছিলো। একজন শিক্ষার্থীকে পার্থিব জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞানও অর্জন করার জন্যে জোর তাগিদ দেয়া হতো। এর কিছু দিন পড়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিকটে একটি ক্লাব গড়ে তোলা হয়। এই ক্লাবে শরীর চর্চা ও নির্মল আনন্দ উপভোগের বিভিন্ন আয়োজন ছিলো। লোকদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় । ইখওয়ানের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের ত্যাগ কুরবানির ও সঠিক পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে আজোও ইখওয়ানের কার্যক্রম বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।


উল্লেখ্য যে, বাহ্রাইন, ইরান, ইরাক, ইসরাঈল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, সৌদিআরব, কুয়েত, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, তাজাকিস্তানে ইখওয়ানের অগ্রযাত্রাকে স্বৈরশাসকেরা বহুবার থামিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। কারণ
ইখওয়ান কোন ব্যক্তির আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেনি। আজো দেশে দেশে ইখওয়ানের দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইখওয়ানের আদলে গঠিত ইসলামী দল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে জয় লাভ করছে। যার বাস্তব প্রমাণ দেখা গেছে আফ্রিকার দেশ মরক্কো, তিউনিশিয়া ও জর্ডানের নির্বাচনে। মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চললেও দলটি যে এখনো মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ওই কয়েকটি দেশের নির্বাচনে তা আবারো প্রমাণিত হলো।


ইখওয়ান মুসলিমকে বেআইনী ঘোষণা :
মিসরের ভূখণ্ডে ইখওয়ানের দাওয়াতী কার্যক্রম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ইখওয়ানের সাংগঠনিক শাখা সংখ্যা প্রায় দুই হাজারে উন্নীত হয়। জনশক্তির সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ এ পৌঁছে। ইখওয়ানের অব্যাহত শক্তি বেড়ে যাওয়া দেখে রাষ্ট্রশক্তি ভীত শংকিত হয়ে পড়ে। মাহমুদ ফাহমী আননুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানকে বে আইনী ঘোষণার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র রেখে বলা হলো যে এইগুলো ইখওয়ানের সন্ত্রাসী কাণ্ড। বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়। আর এদিক দিয়ে সমস্ত দায়ভার চাপানো হয় ইখওয়ানের উপর। বলা হলো এইসব হত্যাকান্ড ইখওয়ান সংঘটিত করেছে। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকরা ক্ষমতার সিড়িকে পাকাপোক্ত করার জন্য যা করে থাকে তৎকালীন মিসর সরকারও তা-ই করেছিলো। ১৯৪৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাত তখন এগারোটা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে কায়রোতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে রেডিওতে প্রচারিত খবর শুনছিলেন। খবর প্রচারিত হলো আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হলো যে ইখওয়ান দেশে একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাবার প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কাযালয়ে ছুটে আসে। উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। হাসানুল বান্নাকে তখন গ্রেফতার করা হয়নি। ইখওয়ানের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইখওয়ান পরিচালিত স্কুল,কলেজ,ক্লাব,হাসপাতাল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। ইখওয়ান মুসলিম প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত দেশে দেশে নিষিদ্ধ হলেও ইখওয়ানের অগ্রযাত্রাকে বাতিল শক্তি দমিয়ে রাখতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইখওয়ান কোন ব্যক্তির আদর্শ বাস্তাবায়ন করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইখওয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করার প্রত্যয় নিয়ে।


ইখওয়ান নেতাদের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট :
ইখওয়ানের নেতাকর্মীদের উপর নেমে আসে জুলুম-নির্যাতনের অব্যাহত ক্রমধারা। সারা দেশে ইখওয়ানের লোকদের গ্রেফতার করা হয়। জেলখানায় তাদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর লোমহর্ষক নির্যাতন। কেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করা হয়,কিন্তু হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার করা হয়নি। কেন গ্রেফতার করা হয়নি সে প্রসঙ্গে শায়খ হাসানুল বান্না বলতেন, তাঁকে গ্রেফতার না করার অর্থ হচ্ছে যে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় হাসানুল বান্না মিটিং শেষে শুববানুল মুসলেমুনের (ইখওয়ানের যুবসংগঠন) কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বের হন। রাস্তায় নেমে তিনি ট্যাক্সীতে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আততীয় গুলি এসে বিঁধে তাঁর বুকে। পিচ ঢালা পথ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। শায়খ হাসানুল বান্নার সাথীরা তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই শায়খ শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহ এই মর্দে মুমীন চলে গেলেন তাঁর প্রভুর আপন সান্নিধ্যে। লাশ পাঠানো হয় তাঁর বাসায়। পুলিশ এসে বাড়ির চারদিকে ঘেরাও করে ফেলে। নিকট আত্মীয় ব্যতিত আর কাউকে ইমামের বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সরকারের আজ্ঞাবহ ট্যাংক বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহকারে তাঁর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দূরে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। সরকার তাদেরকে তাঁর জানাযা ও দাফন কাজে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি।

আজোও পৃথিবীর দেশে দেশে এমন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এই দৃশ্য নতুন কিছু নয়! তবে নবী ও রাসূলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একই দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। শায়খ হাসানুল বান্নার পর আবদুল কাদের আওদাহ, সাইয়েদ কুতুব ও হামিদা কুতুবসহ অসংখ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা তো দেশবিরোধী কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না, তাহলে কেন তাদেরকে শহীদ করা হয়েছে? এই বিষয়টি ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সাইয়্যেদ কুতুবের সহিত এমন নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে যা পড়লে কারো কারো মনে অবিশ্বাস্য হতে পারে! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে জেলখানার কর্মচারীরা কুতুবকে নির্মমভাবে মারপিট করতে থাকে। এতেই শেষ নয়, একপর্যায়ে বর্বর জালেমরা তাঁর ওপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেয়। কুকুরটি তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে এদিক-ওদিক বেড়াতে থাকে। রক্তাক্ত বেদনায় জর্জরিত শরীর ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। তারপরেও তিনি ঈমানের বলে বলীয়ান পাহাড়ের মতো অবিচল ছিলেন। এ অবস্থায়ও তাঁর মুখ থেকে উচ্চস্বরে উচ্চারিত হতে থাকত আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।


সাইয়্যেদ কুতুব ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তাররা কারগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সাইয়্যেদ কুতুবকে মুক্তি প্রদান করা হয়। পুনরায় যখন তাঁকে গ্রেফতার করা হলো তখন তিনি গ্রেফতারী পরওয়ানা দেখে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, "আমি জানি জালেমরা এবার আমার মাথাই চায়। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। নিজের মৃত্যুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার তো বরং সৌভাগ্য যে আল্লাহ্র রাস্তায় আমার জীবনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। তবে আগামীকালের ইতিহাস প্রমাণ করবে যে, ইখওয়ানুল মুসলেমুন সঠিক পথের অনুসারী ছিল,নাকি এই জালেম শাসকগোষ্ঠীই সঠিক পথে ছিল।"


শুধু তাকেই নয়, তার ভাই মুহম্মদ কুতুব, ভগ্নি হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশিসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে প্রায় সাতশ’ মহিলা ছিলেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারক জামাল নাসেরের সাথে আলোচনা করে ১৯৬৬ সালের ২১ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত ৪৩ জন নেতাকর্মীর মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরা হলেন- সাইয়্যেদ কুতুব, মুহাম্মদ ইউসুফ, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, শবরী আরাফাহ, আহমদ আবদুল মজিদ, আব্দুল আজিজ ও আলী উসমাভী। সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনার পর আদালতে কান্নার রোল পড়ে যায়। অথচ সাইয়্যেদ কুতুব রায় শোনার পর খুশি মনে বলে উঠলেন আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি হাসতে হাসতে যা বললেন তা সত্যিই মুসলিম মিল্লাতের ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের প্রেরণা জোগাবে। তিনি বলেন, "আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে, আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে যালিমরা আমার মৃত্যুদণ্ড দেবে। আমিতো এতেই সন্তুষ্ট যে, আমি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দাহ্ হিসেবে শাহাদতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি।’’ এর পরের দৃশ্য বড়ই করুণ। ২৮ আগস্ট রাতে সাইয়্যেদ কুতুব ও তার দুই সাথীকে ফাঁসীর সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৯ আগস্ট ভোর রাত। সাইয়্যেদ কুতুব ও তার দুই সঙ্গীকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়েদ অত্যন্ত আনন্দিত। দৃঢ় মনোবল চিত্তে সামনে পা বাড়াচ্ছেন,তার মুখে আনন্দের হাসি। সাইয়্যেদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন। চারদিকে ভেসে উঠল ফজরের আযান। এমনি এক পবিত্র পরিবেশে কার্যকর করা হলো ইতিহাসের জঘৃণ্যতম আয়োজন।


হাসানুল বান্না থেকে মুরসি :
আমরা লক্ষ্য করেছি যখনই দুনিয়ার কোনো প্রান্তে ইসলামপন্থীরা কোনো বিপর্যয়ের স্বীকার হয় অথবা ভোটের রাজনীতিতে সামান্য ব্যবধানে হেরে যায় তখনই ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে বসে যে, পলিটিক্যাল ইসলাম কার্যত ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়েছে। ইখওয়ানের রাজনৈতিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করা ব্যতীত ইখওয়ান সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ যুগে যুগে ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে বিকৃতভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে। তা থেকে বাদ যায়নি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন। ১৯৩৬ সালে হাসানুল বান্না নাহাস পাশার সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমামের পরামর্শ আমলে নেয়নি। হুছাইন সিররী পাশার পর মুস্তফা নাহাস পাশার মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। নাহাস পাশার পরে আহমদ মাহেরের সময় ইখওয়ান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয় লাভ করেন। কিন্তু ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে মিসরীয় সরকার একটা সাজানো অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন বাতিল করে দেয়। দ্বিতীয়বার নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এমন তৎপরতা চালানো হয় যে ইখওয়ানের কোনো প্রার্থীকে বিজয়ের মুখ দেখতে দেয়া হয়নি। ১৯৫৪ সাল আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে জামাল আব্দুন নাসেরের বিপ্লবের প্রতি ইখওয়ানুল মুসলিমিন সমর্থন জানায়। কিন্তু মত পার্থক্য ও অবিশ্বাসের কারণে দুপক্ষের মধ্যে অতি দ্রুত ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট নাসের ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান পরিচালনা করে। জামাল আবদুন নাসের এক হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর আবার ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জামাল আব্দুন নাসেরের শাসনামলে হাজার হাজার ইখওয়ান নেতাকর্মীকে গ্রেফতার নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সাল আনোয়ার সাদাত মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

Anwar Sadat

সাদাত সরকারের সঙ্গে ইখওয়ানের তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। আনোয়ার সাদাত ইখওয়ান নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফিলিস্তিনি ও আরব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ১৯৭৯ সালে গাদ্দার আনোয়ার সাদাত ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে চেপে বসা ইসরাইল প্রথম একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। ১৯৮১ সালে এক সামরিক কুচকাওয়াজের সময় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তরুণ সেনা কর্মকর্তা খালিদ ইস্তাম্বুলি প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে গুলি করে হত্যা করে।

আনোয়ার সাদাতের অত্যাচার-নিপীড়ন শেষ হতে না হতে ১৯৮৪ সালে ক্ষমতায় আসেন হোসনী মুবারক। তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে একটি ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু এটিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানান।

Hosni Mubarak

এ কারণে ইখওয়ানের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। ২০০৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইখওয়ানের প্রার্থীরা মিসরের পার্লামেন্টের এক পঞ্চমাংশ আসন লাভ করেন। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটে ইখওয়ানের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে মিসরের স্বৈরশাসক হোসনী মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইখওয়াননুল মুসলিমিন আবার রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শাখার নাম দেয় ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি।



আবারো আলোচনায় ইখওয়ান :
২০১২ সালের ৩০ জুন দেশটির প্রথম অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ মুসলিম ব্রাদারহুড ৫১.৭৩ শতাংশ ভোট পায় এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ব্রাদার হুড নেতা মোহাম্মদ মুরসি।


এই প্রথম দেশটিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট যার গাড়ীবহর ট্রাফিক ,ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়ার পরির্বতে সচল রেখেছেন। শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থা নয়, তিনি একজন ওড়না পরিহিত নারীকে খবর পরিবেশন করার অনুমতি প্রদান করে নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেন, যা মিসরের ৫২ বছরের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভের পর মিসরের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মুহাম্মদ মুরসি। কিন্তু একটি ইসলামপন্থী দলের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ মিসরে ক্ষমতায় যাওয়াকে সুনজরে দেখতে পারেনি ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর নীরব সম্মতিতে জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালের জুলাই এ মিসরের অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতা গ্রহণ করেন জেনারেল সিসি।


সুপ্রিম সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরকে অন্তর্বতী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। মোহাম্মদ মুরসিকে গৃহবন্দি করা হয়। ৪ জুলাই তাকে মিশরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ৫ জুলাই অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আদলি ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার পর দেশটিতে ৪১ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর পরই মিসরের একটি আদালত দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ফাঁসির রায় দেয়


অভিযোগ আনা হয় তার ১০৫ সহযোগীর বিরুদ্ধে। তাদের সবাইকে ফাঁসি দেয়ার রায় দেয় আদালত। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও স্বৈরশাসক সামরিক জান্তা সিসির বোধোদয় হয়নি। মুরসি ছাড়া আরো যাদেরকে মিসরের জুডিশিয়াল গিলোটিনে দন্ডিত করা হয়েছে তারা হলেন- ইউসুফ আল কারযাভী, এমাদ শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মিশরীয় রাজনৈতিক বিজ্ঞানী। এছাড়াও একজন সাবেক ইখওয়ান সংগঠক এবং কিছু মৃত ব্যক্তি ও ইসরাইলে কারারুদ্ধ কিছু ফিলিস্তিনিকে সাজা দেয়া হয়েছে। পরবর্তিতে বৈশ্বিক চাপে সেটিকে স্থগিত রেখে তার ব্যপারে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগ এনে তার বিরূদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। গত ২০১৯ সালের ১৭ই জুন আদালত চলাকালীন সময়ে মহান এই নেতা আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। মিসর সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছে। যে সমস্ত গণমাধ্যমের বক্তব্য সরকারের বক্তব্যের বিপক্ষে যাচ্ছে সরকার এমন গণমাধ্যম সব বন্ধ করে দিয়েছে। মিসরের ইতিহাসে এ ঘটনা স্বাধীনতায় সর্বশেষ কুঠারঘাত।

তবে ইতিহাসের এটাই সর্বশেষ অধ্যায় নয়। রাসূল পাক (সাঃ) এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এ অধ্যায়ের অবসান হবে এবং এরই পটভূমিতে আবার কায়েম হবে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ইসলামী খেলাফত। চরম ধৈর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আবারো বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ্।

Post a Comment

0 Comments