ইজ্জেদ্দিন আল কাসসামঃ যায়নবাদীদের আতংকের প্রথম নাম



ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম। যে নাম শুনলে যায়নবাদী ইহুদীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের আঘাতের জবাবে কাসসাম বিগ্রেডের শক্ত প্রতিরোধে নাজেহাল হয়ে পড়েছে দখলদার ইসরাইল।

কে ছিলেন এই ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম? কেনই বা আজ তিনি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ?

পরিচয়ঃ
উনার আসল নাম ইজ্জেদ্দিন বিন আব্দুল কাদির বিন মুস্তাফা বিন ইউসুফ বিন মুহাম্মাদ আল কাসসাম। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন। পেশায় ছিলেন একজন আলেম ও বক্তা।
জীবনীঃ
ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম, ১৮৮২ সালে বর্তমান সিরিয়ার লাজকিয়ে শহরের জাবালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর পর্যন্ত তিনি পারিবারিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে মিশরের কায়রোতে অবস্থিত বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তিনি সিরিয়ায় নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং গ্রামের মসজিদে ইমামতির কাজ শুরু করেন। উনার ওয়াজসমূহে ইসলামের পুনর্জাগরণ শুধুমাত্র ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই যে সম্ভব এবং এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় শত্রু যে সাম্রাজ্যবাদ, তা জনগণের মাঝে তুলে ধরার চেস্টা করেন। তাঁর বক্তব্যসমূহ সমগ্র সিরিয়াতে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে তিনি শুধুমাত্র উনার আদর্শের মৌখিক প্রচার করেই ক্ষান্ত হন নি বরং ১৯১১ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইতালির ত্রাব্লুস দখলের সময় সরাসরি ওসমানী সৈন্যদের সাথে এক হয়ে ময়দানে যুদ্ধ করেছেন।

পরবর্তীতে ওসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করা কাসসাম, সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের শাম দখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে জনগণকে এক করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এসময় ফ্রান্স সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি ও মৃত্যুদণ্ড পরোয়ানা জারি করে।

১৯২২ সালে তিনি সিরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং পরবর্তীতে ফিলিস্তিনের হাইফা শহরের নিকট এক গ্রামে বসবাস করা শুরু করেন। সেসময় তিনি ফিলিস্তিনের মাটিতে পরিকল্পিতভাবে ইহুদী বসতির কঠোর বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে হাইফার একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং “মুসলিম যুব সংস্থা” (ইয়ং মেন্স মুসলিম এসোসিয়েশন) তে যোগদান করেন। সেখানে তিনি আল ফাতাহ আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক পথপ্রদর্শক আমিন আল হুসেইনির সাথে পরিচিত হন। তবে সে সময় আমিন আল হুসেইনির জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার সাথে তিনি একমত হতে পারেননি কারণ আল কাসসামের চিন্তা চেতনায় ইসলামী ঐক্য ছিল মূল বিষয়। বহু বছর পর অবশেষে তাঁদের চেতনার ফসল হিসেবে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন বা পিএলও(PLO) এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতেহামাস আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে।
জিহাদ ও শাহাদাতঃ
শায়েখ ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম, দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নিমিত্তে ছোট ছোট গেরিলা বাহিনী গঠন করেন এবং লেবানন-ফিলিস্তিন সীমান্তে যুদ্ধ করেন। আল কাসসামের গেরিলা সংগ্রাম ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাকারী ব্রিটিশদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৫ সালে আল কাসসাম, ৫০০ ব্রিটিশ সৈন্যের সুসজ্জিত এক বাহিনীর আক্রমণে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম, ১৯৩৫ সালের ১৯ নভেম্বর কয়েকজন মুজাহিদের সাথে একত্রে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াবেদ পাহাড়ে গমন করেন। সেসময় ব্রিটিশদের পক্ষে গোয়েন্দার ভূমিকা পালন করা কারো একজনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা তাঁদের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। সম্পূর্ণ সশস্ত্র ও সুসজ্জিত ৫০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য আল কাসসাম ও তাঁর সহযোগীদের স্থল ও আকাশ পথে একযোগে হামলা করে অবরোধ করা শুরু করে। সেসময় আল কাসসাম শুধুমাত্র ১৪ জন মুজাহিদ নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। ফজরের পর থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত ১৪ জন মুজাহিদ সশস্ত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রানপণ লড়াই চালিয়ে যান। ময়দানে ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম, শাইখ ওমর হাসান সাদি ও শাইখ হানাফি শাহাদাত বরণ করেন এবং বাকি মুজাহিদ্গণ ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হোন।

মহান এই সেনাপতির রেখে যাওয়া মীরাসঃ
ব্রিটিশরা শাইখ আল কাসসামের মৃত্যুর পরে এই আন্দোলন থেমে যাবে ভাবলেও মূলত তার বিপরীতটি ঘটে, তিনি ফিলিস্তিনিদের মাঝে আরও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া শুরু করেন। তাঁর জানাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে আল কাসসামের আদর্শিক সংগ্রাম আরও বেশি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
শেষকথাঃ বর্তমানে হামাসের সশস্ত্র সংগ্রামের যোদ্ধা বাহিনীর নামকরণ মূলত তাঁর নামেই করা হয়েছে – আল কাসসাম বিগ্রেড। এছাড়াও হামাসের ব্যবহৃত রকেটগুলোর নামও এই আল কাসসামের নামেই নামকরণকৃত হয়েছে, যা কিনা আল কাসসামের শাহাদাতের প্রায় ১০০ বছর পরেও এখনো দখলদার ইসরাইলীদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments